চিন্তার ইবাদত
Sajjadur Rahman
![]() |
Sajjadur Rahman |
চিন্তার ইবাদত
ভূমিকা :
মানুষের দৈহিক ইবাদত তিন ভাগে বিভক্ত। অন্তরের ইবাদত, মৌখিক ইবাদত এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইবাদত। অনেকে ইবাদত বলতে শুধু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মৌখিক ইবাদতকেই বুঝে থাকেন। কিন্তু অন্তরের ইবাদত সম্পর্কে তারা উদাসীন থাকেন। অথচ অন্তরের ইবাদতের উপর ভিত্তি করেই অন্যান্য সকল ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদিত হয়। সেকারণ অন্তরের ইবাদতে বেশী জোর দেওয়া উচিত। কেননা হৃদয় যখন ইবাদতে রত হয়ে যায়, তখন হাত, পা, জিহবা, কান, চোখ সহ শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত হয়ে যায়। আর অন্তরের যত শক্তিশালী ইবাদত আছে, তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল চিন্তার ইবাদত।
চিন্তা বলতে কী বুঝায়?
চিন্তা হ’ল মানব মস্তিষ্কের অপরিহার্য ক্রিয়া। চিন্তাশক্তি থাকার কারণেই অন্যান্য প্রাণীর উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। চিন্তা-ভাবনাকে আরবীতে ‘তাফাক্কুর’ (التَّفَكُّرُ) বলা হয়। এর আরবী প্রতিশব্দগুলো হ’ল-التَّأَمُّلُ، التَّدَبُّرُ، العِبْرَةُ، النَّظْرَةُ،। আর এর বাংলা প্রতিশব্দ হ’ল- গভীর চিন্তা, ধ্যান, ভাবনা, উপদেশ, শিক্ষা লাভ প্রভৃতি। কুরআন ও হাদীছে এই শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।
যে কোন কাজের শুরুতে ভেবে দেখা উচিত সেই কাজটি ভালো না-কি মন্দ; হালাল না-কি হারাম। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরী থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে চিন্তা-ভাবনা করা যরূরী। কেউ যদি কোন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে চিন্তার ইবাদতের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব না দেয়, তাহ’লে খুব সহজেই সে হারাম ও পাপের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হবে। চিন্তা যে একটি ইবাদত মানুষ তা জানেই না। হাজার হাজার ওয়াজ মাহফিল হয় কিন্তু কোথাও চিন্তার ইবাদতের কথা শুনা যায় না।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হ’ল ভালো-মন্দ সবকিছু চিন্তা-ভাবনা থেকেই উৎপন্ন হয়। কারণ চিন্তাই হচ্ছে ইচ্ছা শক্তির মূল ভিত্তি।
পবিত্র কুরআনের প্রায় একশত আয়াতে মহান আল্লাহ চিন্তার ইবাদতে রত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ، ‘এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শন সমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-গবেষণা করতে পার’ (বাক্বারাহ ২/২১৯)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ مَا خَلَقَ اللهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّى وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ بِلِقَاءِ رَبِّهِمْ لَكَافِرُونَ، أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَأَثَارُوا الْأَرْضَ وَعَمَرُوهَا أَكْثَرَ مِمَّا عَمَرُوهَا وَجَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَمَا كَانَ اللهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
‘তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না যে, আল্লাহ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য? কিন্তু অনেক মানুষ তাদের পালনকর্তার সাথে সাক্ষাতে অবিশ্বাসী। তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না, অতঃপর দেখে না যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণতি কিরূপ হয়েছে? তারা তাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী ছিল। তারা যমীনে চাষাবাদ করত এবং তাতে আবাদ করত যা এরা আবাদ করে তার চাইতে বেশী। তাদের নিকট তাদের রাসূলগণ এসেছিল সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে। অতঃপর আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতে চাননি। কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (রূম ৩০/৮-৯)।
উবাইদ ইবনে উমাইর (রহঃ) বলেন, আমি আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে বললাম,أَخْبِرِينَا بِأَعْجَبِ شَيْءٍ رَأَيْتِهِ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এমন অবস্থান সম্পর্কে আমাদের বলুন, যা আপনার কাছে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে’। এ প্রশ্নের পর আয়েশা (রাঃ) চুপ থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘কোন এক রাতের কথা। রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন,يَا عَائِشَةُ ذَرِينِي أَتَعَبَّدُ اللَّيْلَةَ لِرَبِّي ‘হে আয়েশা! আমাকে ছাড়। আজ সারা রাত আমি আমার রবের ইবাদত করব’। তাঁর কথার প্রত্যুত্তরে আমি বললাম,وَاللهِ إِنِّي لَأُحِبُّ قُرْبَكَ وَأُحِبُّ مَا سَرَّكَ، ‘আল্লাহর কসম! আমি আপনার সঙ্গ ভালোবাসি এবং আপনাকে যা আনন্দিত করে, তাও আমি ভালোবাসি’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘তিনি (আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে) উঠে পড়লেন। তারপর পবিত্রতা অর্জন করে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি কাঁদতে থাকলেন, ফলে অশ্রুতে তার গাল ভিজে গেল। তিনি আবার কাঁদতে থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার দাঁড়ি অশ্রুতে ভিজে গেল। তিনি আবার কাঁদতে থাকলেন। তাঁর চোখের পানিতে মাটিও ভিজে গেল। অতঃপর (ফজর) ছালাতের আযান দেওয়ার জন্য বেলাল (রাঃ) আসলেন। এসে দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাঁদছেন। তিনি বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ لِمَ تَبْكِي وَقَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ وَمَا تَأَخَّرَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাঁদছেন কেন? আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَفَلَا أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا لَقَدْ نَزَلَتْ عَلَيَّ اللَّيْلَةَ آيَةٌ وَيْلٌ لِمَنْ قَرَأَهَا وَلَمْ يَتَفَكَّرْ فِيهَا: {إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ} ‘আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? (শুনে রাখ!) আজ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে। ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য, যে এই আয়াত তেলাওয়াত করল, কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করল না। অতঃপর তিনি তেলাওয়াত করলেন,إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ، ‘নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে জ্ঞানীদের জন্য (আল্লাহর) নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১৯০)।[8]
আবুদ্দারদা (রাঃ) যে ইবাদত সবচেয়ে বেশী করতেন, সেটা হ’ল চিন্তা-ভাবনা’।[11] হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, أَفْضَلُ الْعِبَادَةِ التَّفَكُّرُ وَالْوَرَعُ ‘শ্রেষ্ঠ ইবাদত হ’ল চিন্তা-ভাবনা এবং আল্লাহভীরুতা’।[12] সুতরাং বোঝা গেল, আখেরাতমুখী চিন্তা-ভাবনা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
১. আল্লাহ তায়ালা সুরাতুদ দাহারে বলেন هل اتى على الانسان حين من الدهر لم يكن شاْ مذكورـ انا خلقنا الانسان من نطفة امشاج نبتليه فجعلناه سميعا بصيراـ
২.হেরা গুহায় রাসূল (ছাঃ)-এর ধ্যান :
কা‘বা গৃহ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম ‘জাবালে নূর’। এ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ‘হেরা গুহা’ ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি আধ্যাত্মিক শিক্ষায়তন। তিনি নবুঅত লাভের আগ মুহূর্তে মক্কার কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে দূরে হেরা গুহার নিরিবিলি স্থানকে বেছে নেন। আল্লাহ এই ছোট গুহাকে তার প্রিয় স্থানে পরিণত করে দেন। ফলে বাড়ীতে তাঁর মন বসতো না। তাই ছাতু ও পানি নিয়ে চলে যেতেন হেরা গুহায়। কখনো কখনো খাদীজা (রাঃ) সেখানে তাঁকে খাবার পৌঁছিয়ে দিতেন। মানবতার মঙ্গল চিন্তায় নিঃসঙ্গপ্রিয়তা এবং আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়া ছিল নবুঅত প্রাপ্তির পূর্ব নিদর্শন। যা ছিল মহান আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং মহতী ব্যবস্থাপনার অংশ।
রাসূলুল্লাহ প্রতি বছর এক মাস করে হেরা গুহায় অবস্থান করতেন’।[24]
মূলতঃ মহান আল্লাহর ইশারায় রাসূল (ছাঃ) এই নির্জন গুহাতে ধ্যান করতেন এবং
চিন্তার ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন (أَنَّهُ كَانَ يَتَعَبَّدُ بِالتَّفَكُّرِ)।[25]
এভাবে চিন্তার ইবাদতে রত থাকাবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নিয়ে হাযির হন
স্বয়ং জিব্রীল (আঃ)। অবতীর্ণ হয় হেদায়াতের দিশারী মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের
সূরা ‘আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন