নামাজরত অবস্থায় নবিজিকে কষ্ট দেয়া ও ছালাত আদায়ে বাধা সৃষ্টি।

Sajjadur Rahman

 

কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় নবি সাঃকে কষ্টদান (ايذاء النبى صــ فى الصلاة عند الكعبة)

(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (ছাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে? তখন ওক্ববা বিন আবী মু‘আইত্ব উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না। এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফৎহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,

اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ- ثُمَّ سَمَّى- اللهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدُ اللهِ فَوَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى يَوْمَ بَدْرٍ، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ قَلِيبِ بَدْرٍ- متفق عليه-

‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধর’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।[1] উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।[2]

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হ’তে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)। কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহ্ল গং রাসূল (ছাঃ)-এর বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়। আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।

উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হ’তে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হ’ল তিনি এদের ‘অধিকাংশ’কে দেখেছেন। কেননা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়। উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হ’লেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কূয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কূয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।[3] অতঃপর ‘উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল।[4]

(খ) একদিন ছালাতরত অবস্থায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (ছাঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন,أَتَقْتُلُونَ رَجُلاً أَنْ يَقُولَ رَبِّىَ اللهُ؟ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ এ সময় তারা রাসূল (ছাঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)

ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)

রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ- (مؤمن ২৮)-

‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)

আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’।[5]

[1]. বুখারী হা/৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪; মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব ও অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুসলিম হা/১৭৯৪; বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০, ১/৪১৭ পৃঃ; মা শা-‘আ ৫০ পৃঃ।

[3]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৮১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[4]. বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৮৩৩।

[5]. মুসনাদে বাযযার হা/৭৬১। ইবনু হাজার এটিকে বুখারী হা/৩৮৫৬-এর ‘সমর্থক’ (شاهد) হিসাবে এনেছেন। হায়ছামী বলেন, এর সনদে একজন রাবী আছেন, যাকে আমি চিনি না (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৩৩৩)।

 

কা‘বাগৃহে ছালাত আদায়ে বাধা সৃষ্টি (منع النبى صـ من الصلاة فى بيت الله)

(ক) নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই ছালাত ফরয হয়। তবে তখন ছালাত ছিল কেবল ফজরে ও আছরে দু’ দু’ রাক‘আত করে (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে (অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে ও সূর্যোদয়ের পূর্বে)’।[1] আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।[2] এছাড়া রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।[3]

প্রথম দিকে সবাই সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বাগৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল,يَا مُحَمَّدُ، أَلَمْ أَنْهَكَ عَنْ هَذَا؟ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব থেকে নিষেধ করিনি?’

তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,يَا مُحَمَّدُ بِأَيِّ شَيْءٍ تُهَدِّدُنِي؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لَأَكْثَرُ هَذَا الْوَادِي نَادِيًا ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ হে মুহাম্মাদ? আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে ভারি। তখন আল্লাহ সূরা ‘আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াতগুলি নাযিল করেন।[4]

كَلاَّ إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَى- كَلاَّ لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلاَّ لاَ تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ- (العلق ৬-১৯)-

‘কখনোই না। নিশ্চয়ই মানুষ সীমালংঘন করে’ (৬)। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (৭)। ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের নিকটেই প্রত্যাবর্তন স্থল’ (৮)। ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে (আবু জাহলকে) যে নিষেধ করে?’ (৯)। ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে), যখন সে ছালাত আদায় করে’ (১০)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে সৎপথে থাকে’ (১১)। ‘অথবা আল্লাহভীতির আদেশ দেয়’ (১২)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (১৩)। ‘সে কি জানেনা যে, আল্লাহ তার সবকিছুই দেখেন’ (১৪)। ‘কখনোই না। যদি সে বিরত না হয়, তবে আমরা অবশ্যই তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে সজোরে টান দেব’(১৫)। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’ (১৬)। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’ (১৭)। ‘আমরাও অচিরে ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’ (১৮)। ‘কখনোই না। তুমি তার কথা শুনবে না। তুমি সিজদা কর এবং আল্লাহর নৈকট্য তালাশ কর’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-১৯)

আবু জাহ্ল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে একটি সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।[5] আর এটাই হ’ল কুরআনের ১৫তম ও সর্বশেষ সিজদার আয়াত’ (দারাকুৎনী হা/১৫০৭)। উল্লেখ্য যে, এই সিজদার জন্য ওযূ, কিবলা বা সালাম করা শর্ত নয়।

উপরোক্ত ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, দূরদর্শী কাফের-মুশরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা মুসলমানদের ব্যক্তিগত ইবাদতকেই বেশী ভয় পায়। যদিও তারা মুখে বলে যে, ধর্মের ব্যাপারে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কেননা তাদের মতে ধর্ম হ’ল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। অথচ নেতারা ভালভাবেই জানেন যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু তার বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আবু জাহ্ল ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। তাই তিনি মূল জায়গাতেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কা‘বাতে একবার আল্লাহর জন্য সিজদা চালু হ’লে পাশেই রক্ষিত দেব-দেবীর সম্মুখে কেউ আর মাথা নীচু করবে না। তাদের অসীলায় কেউ আর মুক্তি চাইবে না এবং সেখানে কেউ আর নযর-নেয়ায দিবে না। অথচ অসীলাপূজার এই শিরকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের অর্থবল, জনবল, সামাজিক সম্মান সবকিছুর চাবিকাঠি। বর্তমান যুগের কবরপূজারী ও ওরস ব্যবসায়ী মুসলমানদের অবস্থা সেযুগের আবু জাহ্লদের চাইতে ভিন্ন কিছুই নয়। সেদিন যেমন কা‘বার পাশেই মূর্তিপূজা হ’ত, এখন তেমনি মসজিদের পাশেই কবরপূজা হয় ও সেখানে নযর-নেয়ায দেওয়া হয়। ধর্মের নামে এইসব ধর্মনেতারা ধার্মিক মুসলমানদের তাওহীদ থেকে ফিরিয়ে শিরকমুখী করে। একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী নেতারা চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুকৌশলে দ্বীনদার মুসলিম নর-নারীকে তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।

(খ) সূরা ‘আলাক্ব-এর উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর আবু জাহ্ল মনে মনে ভীত হ’লেও বাইরে ঠাট বজায় রেখেই চলেন। একদিন তিনি কুরায়েশ নেতাদের সামনে বলে বসেন, লাত ও উয্যার কসম! যদি মুহাম্মাদকে পুনরায় সেখানে ছালাতরত দেখি, তাহ’লে নিশ্চিতভাবেই আমি তার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে তার নাকমুখ মাটিতে আচ্ছামত থেৎলে দেব’ (মুসলিম)। পরে একদিন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সেখানে ছালাতরত অবস্থায় দেখলেন। তখন নেতারা তাকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উসকে দিল। ফলে তিনি খুব আস্ফালন করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। আর দুই হাত শূন্যে উঁচু করে কি যেন এড়াতে চেষ্টা করছেন’। পিছিয়ে এসে তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমার ও তার মধ্যে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড দেখলাম, যা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَوْ دَنَا مِنِّى لاَخْتَطَفَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ عُضْوًا عُضْوًا ‘যদি সে আমার কাছে পৌঁছত, তাহ’লে ফেরেশতারা তার এক একটা অঙ্গ ছিন্ন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত’।[6] আশ্চর্যের বিষয়, এতবড় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও এবং রাসূল (ছাঃ)-এর উপর আল্লাহর সরাসরি সাহায্য প্রত্যক্ষ করেও আবু জাহ্ল তার হঠকারিতা থেকে পিছিয়ে আসেননি কেবলমাত্র নেতৃত্বের অহংকারে স্ফীত হওয়ার কারণে। নমরূদ, ফেরাঊন ও আবু জাহল সহ যুগে যুগে সকল হঠকারী নেতাদের চরিত্র একই।

(গ) শিস দেওয়া ও তালি বাজানো(المكاء والةصدية عند الصلاة فى الكعبة) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বাগৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত ও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো যায়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءً وَّتَصْدِيَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ ‘আর বায়তুল্লাহ্র নিকটে তাদের ইবাদত বলতে শিস দেওয়া ও তালি বাজানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতএব (ক্বিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে) তোমরা অবিশ্বাসের শাস্তি আস্বাদন কর’ (আনফাল ৮/৩৫)

(ঘ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহ্ল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিলেন যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- (فصلت ২৬-২৭)-

‘আর কাফেররা বলে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা বিজয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কৃতকর্মের নিকৃষ্টতম বদলা দেব’ (ফুছসালাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)। এছাড়াও তারা নানাবিধ গালি দিত। তখন নাযিল হয়-وَلاَ تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ وَلاَ تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيْلاً ‘আর তুমি তোমার ছালাতের ক্বিরাআতে স্বর অধিক উঁচু করো না বা একেবারে নীচু করো না। বরং দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর’ (ইসরা ১৭/১১০)।[7]

[1]. গাফির/মুমিন ৪০/৫৫; মির‘আত ২/২৬৯।

[2]. মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১।

[3]. মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী।

[4]. ত্বাবারী, তাফসীর ‘আলাক্ব ১৮ আয়াত; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৫; তিরমিযী হা/৩৩৪৯।

[5]. মুসলিম হা/৫৭৮; বুখারী হা/১০৭৪; মিশকাত হা/১০২৪ ‘সুজূদুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।

[6]. ইবনু হিশাম ১/২৯৯ টীকা -৪; মুসলিম হা/২৭৯৭, মিশকাত হা/৫৮৫৬।

ইবনু ইসহাকের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) সিজদায় গেলে আবু জাহ্ল পাথর উঠিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই দ্রুত ভয়ে পিছিয়ে এল। এ সময় তার হাতের পাথরখন্ডটা এমনভাবে চিমটি লেগে গেল যে, সে তা হাত থেকে ছাড়াতে পারছিল না। লোকেরা তার অবস্থা কি জিজ্ঞেস করলে সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, একটা ভয়ংকর উট আমাকে খেতে আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জিব্রীল স্বয়ং উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে তাকে ভয় দেখিয়েছিল। কাছে এলে তাকে ধরে নিত’ (ইবনু হিশাম ১/২৯৮; বায়হাক্বী দালায়েল ৪/১৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৯)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৮-৪৯)। এ ব্যাপারে ছহীহ বর্ণনা সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

[7]. বুখারী হা/৭৪৯০; মুসলিম হা/৪৪৬; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বনু ইস্রাঈল ১১০ আয়াত।

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহানবি সাঃ এর মুখের লালা।

শয়তান যে ৩ কাজে মানুষকে সবচেয়ে বেশি ধোঁকা দেয় ।

মুসলিম সমাজে মসজিদের ভূমিকা